খবরের বিস্তারিত...


হযরত গাউছুল আজম ছৈয়দ গোলামুর রহমান বাবাজান কেবলা (রহঃ) জীবনী


হযরত বাবা ভান্ডারী (রঃ) হচ্ছেন মাইজভান্ডার দরবার শরীফের দ্বিতীয় মহান ওলী। তিনি ১২৭০ সালের ২৭শে আশ্বিন (মোতাবেক ১০ই অক্টোবর ১৮৬৫ইং এবং ১২ই জামাদিউসসানী ১২৭০ হিজরী) সোমবার ভোর বেলা চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি থানার অন্তর্গত মাইজভান্ডার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ আবদুল করিম শাহ সাহেব এবং মাতার নাম সৈয়দা মুশাররফজান বেগম সাহেবা। তিনি হযরত গাউছুল আজম শাহ সুফী সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডার (রঃ)- এর আপন ভাতষ্পুত্র। তাঁর জন্মের অব্যবহিত পর নবজাত শিশু অবস্থায় তাঁকে দেখে তাঁর আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীগণ আনন্দে পুলকিত হয়ে মন্তব্য করেছিল, “এ শিশু মানব নয়, বরং একজন সম্মানিত ফেরেশতা। আমরা এরূপ সুন্দর ছেলে কখনও দেখিনি। নিশ্চই ইনি কালে একজন উচ্চ মর্যাদার ওলী হবেন”  হযরত বাবা ভান্ডারী (রঃ)-এর শিক্ষা জীবন শুরু হয় তাঁর বাড়ীর আঙ্গিনায় সে সময়ে বিদ্যমান একটি ফোরকানীয়া মাদ্রাসায়। ফোরকানীয়া মাদ্রাসাটির শিক্ষক ছিলেন একজন অভিজ্ঞ আলেম ও ধর্ম পরায়ণ লোক। মাদ্রাসা শিক্ষক হযরত বাবা ভান্ডারী (রঃ)-এর পিতাকে একদিন ডেকে বললেন, “আপনার এ শিশু সন্তানকে পাঠ আরম্ভ করে দিন, কালে ইনি একজন আদর্শ পুরুষ হবেন এবং তাঁর প্রেমের স্পর্শে এসে মাটির মানুষ সোনায় পরিণত হবে।
দুনিয়াব্যাপী তাঁর নামের ডঙ্কা বাজবে”  শিক্ষকের মন্তব্য শুনে বাবা ভান্ডারী (কঃ)-এর পিতা মুগ্ধ হয়ে যান এবং তিনি বাবা ভান্ডারী (কঃ)-কে প্রথম পাঠদান করার জন্য হযরত গাউছুল আজম শাহ সুফী সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (কঃ) সমীপে নিয়ে যান। হযরত আকদাছ (কঃ) বাবা ভান্ডারী (কঃ) কে শিক্ষার্থীর বেশে দেখে মৃদু হাসলেন এবং বললেন “তুমি কালামুল্লাহ পড়বে? আচ্ছা পড় দেখি”   অতপর হযরত আকদাছ (কঃ) পবিত্র কোরআন মজিদ থেকে কিছু আয়াত পাঠ করেন এবং মিলাদ শরীফ পড়ে খোদার দরবারে ভান্ডারী (কঃ)-এর জন্য মুনাজাত করেন। হযরত আকদাছ (কঃ)-এর অনুমোদন পেয়ে হযরত বাবা ভান্ডারী (কঃ) উক্ত ফোরকানীয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে যান এবং পড়াশুনা শুরু করে দেন। মাদ্রাসায় ভর্তি হলে কি হবে? হযরত বাবা ভান্ডারী (কঃ) এর ঝোঁক ছিল সর্বদা হযরত আকদাছ (কঃ)-এর সান্নিধ্য লাভের প্রতি। তিনি প্রায়শঃ হযরত আকদাছ (কঃ)-এর সান্নিধ্যে থাকতে ভালবাসতেন। যদি কখনও তা সম্ভব না হতো তবে একাকী ধ্যানমগ্ন থাকতেন। । তিনি মাঠে গরু চরাতেন। গরু চরানোর মধ্যে তাঁর একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছিল। তিনি গরুকে বলতেন “দেখ! ফসল নষ্ট করিস না”  গরু দিব্যি বাধ্যগত দাসের মত তাঁর কথা মান্য করত। গরুর জমির আলের উভয় পার্শ্বের ঘাস খেয়ে উদর পূর্ণ করত, কিন্তু ফসলের ক্ষতি করত না।

ছোটবেলা থেকেই তিনি নামাজ, রোজা ও কোরআন পাঠে নিজেকে সদাসর্বদা নিয়োজিত রাখতেন।
তিনি প্রতিনিয়ত তাহাজজুদ নামাজও আদায় করতেন। লেখাপড়ায় তিনি ছিলেন মাদ্রাসার সেরা ছাত্র। মোহছেনীয়অ মাদ্রাসায় পড়ার সময় তিনি জায়গীর (লজিং) থাকতেন। জায়গীর থাকাকালে শেষ রাতে চট্টগ্রাম “বহদ্দার মসজিদ” এ সাদা কাপড় পরিহিত সুফিগণের জামাতে তাঁকে বহুবার ইমামতি করতে দেখা গেছে বলে প্রতক্ষদর্শীরা বর্ণনা করেছেন।

হযরত বাবা ভান্ডারী (কঃ) যখন ২৩ বৎসর বয়সে পদার্পণ করেন তখন থেকে তিনি সংসার জীবনের প্রতি নিরাসক্ত হয়ে পড়েন। সংসারের দিকে তার মনোযোগ আকর্ষন করার জন্য তাঁর পিতামাতা ফটিকছড়ি থানার সুয়াবিল গ্রাম নিবাসী সৈয়দ কমর চাঁদ শাহ (রঃ)-এর বংশধর আলহাজ্ব সৈয়দ আশরাফ আলী আল-হাছনী সাহেবের প্রথমা কন্যা মোছাম্মৎ জেবুন্নেছা বেগমের সাথে তাঁকে এ সময়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করান। কিন্তু বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। এক অভিনব ব্যাপার ঘটল তাঁর ২৫ বৎসর বয়সে পদার্পণ করার পর। এ সময় তিনি জমাতে উলার ফাইনাল পরীক্ষার্থী। পরীক্ষা দিতে যাবার পূর্বে হযরত আকদাছ (কঃ)-এর অনুমতি জন্য তিনি দরবার শরীফে এলেন। কিন্তু বেশ কয়েকদিন অতিবাহিত হবার পরও হযরত আকদাছ (কঃ)-এর সাথে কথা বলার তাঁর সুযোগ হল না; অথচ হযরত আকদাছ (কঃ)-এর অনুমতি ছাড়া তিনি পরীক্ষা দিতে কিছুতেই যাবেন না। অগত্যা পরীক্ষার তারিখ ঘনিয়ে আস, তখন সকলের চাপে পড়ে তিনি সৈয়দ মোহাম্মদ হাসেম (তাৎর ভ্রাতা) এবং হযরত আকদাছ (কঃ)-এর পুত্র সৈয়দ ফজলুল হক সাহেবকে সাথে নিয়ে হযরত আকদাছ (কঃ) এর অনুমতির নিতে যান। হযরত আকদাছ (তঃ) তখন দরবার শরীফের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত কাটাখালী নামক খালের তীরে সরিষা ক্ষেতের ধারে তাঁর অনুগত শিষ্যদের উপবিষ্ট ছিলেন। হযরত বাবা ভান্ডারী (কঃ) মস্তক নত করে দাঁড়িয়ে আছেন। হযরত আকদাছ (কঃ) অপলক নেত্রে হযরত বাবা ভান্ডারী (কঃ)-এর দিকে চেয়ে রইলেন এবং জজবা হালে অনেক কিছু বললেন। হযরত আকদাছ (কঃ)-এর জজবা অবস্থায় উচ্চারিত এ সকল কথার মর্মার্থ সাধারণের বোধগম্য হলনা। কিছুক্ষন পর আকদাছ (কঃ) স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলেন এবং বললেন “তোমার পরীক্ষা হয়ে গেছে, বাছা। আমি তোমাকে নাজিরহাটস্থ আশরাফ আলী খলিফার দোকানে খেয়ে মসজিদে থাকতে বলি”  কিন্তু এতে সৈয়দ মোহাম্মদ হাসেম ছাহেব পরিতৃপ্ত হলেন না। তিনি হযরত আকদাছ (কঃ) কে বললেন, তাঁর (হযরত বাবা ভান্ডারী) যে পরীক্ষা হযরত আকদাছ (কঃ), তাঁকে শহরে যেতে হবে”  এতে হযরত আকদাছ বললেন “যাও! তুমি ও ফয়জুল হক মিঞা আমার হুজরার তাকের উপর হতে পীরানে পীরের হরিণী আবাটি (চৌগা) শীঘ্রই নিয়ে আস”। তারা তাঁর আদেশ মত তাই করলেন। হযরত আকদাছ (কঃ) উক্ত হরিনী আবাটি (এক প্রকার জুব্বা) নিজে পরিধান করলেন। কিছুক্ষন পর তিনি উহা খুলে হযরত বাবা ভান্ডারী গায়ে পরিয়ে দিলেন এবং শহরে যাবার অনুমতি দিলেন। বলাবাহুল্য, এটি ঐতিহাসিক ঘটনা। কারণ এর মাধ্যমে তিনি তাঁর ফয়েজ রহমত বাবা ভান্ডারী (কঃ) কে বর্ষণ করলেন এবং মহান ওলীর সনদ প্রদান করলেন। এভাবে যিনি মহান ও অনন্ত পরীক্ষায় পাশ করলেন, তাঁর সীমিত পার্থিব পরীক্ষায় পাশের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল। তিনি পরীক্ষার হলে জমাতে উলা ফাইনাল পরীক্ষা দিতে গেলেন। কোন মতে দু’দিন পরীক্ষা দিলেন। পরীক্ষার তৃতীয় দিনে আধ্যাত্মিক আগনের দহনে তিনি আর স্থির থাকতে পারলেন না। কাগজ কলম সব ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে জজবা হালে অনেক দুর্বোধ্য কথা বললে এবং গজল গাওয়া শুরু করলেন। শিক্ষক ও হলের সকল পরীক্ষার্থীগণ হতভম্ব হয়ে গেলো। এরূপ একজন নামীদামী ছাত্র পরীক্ষা দেবেনা এ কেমনতর কথা। শিক্ষক ও সহপাঠিগণ তাঁকে অনেক বুঝালেন। কিন্তু কোন কাজ হল না। দুনিয়া তাঁর কাছে তখন অতি তুচ্ছ, অতি নগণ্য। তিনি শুধু তকন অন্তরে তাঁর প্রমাস্পদকেই দেখছেন। প্রেমাস্পকেই উদ্দেশ্য করে তিনি বলতে থাকলেন, “এসেছেন আপনি? এসেছেন? আপনি কষ্ট স্বীকার করে কেন এসেছেন? আমি মাথায় ভর দিয়ে হেঁটে আপনার খেদমতে হাজির হতাম”   এরূপ বলতে বলতে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। তাঁর পরীক্ষা পর্ব এখানেই শেষ হয়। তারপর তাঁকে পরীক্ষা হল থেকে জায়গীর বাড়ী এবং জায়গীর বাড়ী থেকে দরবার শরীফে নিয়ে আসা হয়। এ ঘটনার সাথে হযরত আকদাছ (কঃ)-এর আধ্যাত্মিক যোগসূত্র অপূর্ব। হযরত বাবা ভান্ডারী যখন পরীক্ষার তৃতীয় দিনে পরীক্ষার হলে প্রবেশ করে উক্তরূপ ঘটনা করছিলেন, তখন হযরত আকদাছ (কঃ) হযরত বাবা ভান্ডারী (রঃ)-এর জোষ্ঠ্য ভ্রাতা সৈয়দ গোলাম ছোবহান সাহেবকে ডেকে বললেন, “মিঞা, আমি হ্জ্বে যেতে চাই। আমার সারাটা বাগান খুঁজেও একটি গোলাপ ফুল পেলাম না”। হজ্বে যাবার অর্থ পরলোক গনের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে হযরত গোলাম ছোবহান সাহেব কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, “হুজুর, আপনার খাদের গোলামুর রহমান সাহেব (রঃ) শহরে আছেন। তাকে আপনার খেদমতে হাজির করব কি?   হযরত আকদাছ (কঃ) বললেন, “তাঁকে বাড়িতে আনলে ভাল হয়”।

হযরত বাবা ভান্ডারী (রঃ)-এর রেয়াজত সাধনার কিছু চিত্র

হযরত বাবা ভান্ডারী (রঃ)-এর রেয়াজন সাধনা অতীব কঠোর এ কষ্টের। জমাতে উলার ফাইনাল পরীক্ষা না দিয়ে দরবার শরীফে ফিরে আসার পর তাঁর কঠোর আত্মিক সাধনা শুরু হয়। তিনি সর্বদা হযরত আকদাছ (কঃ)-এর খেদমতে হাজির থাকতে লাগলেন। অবসর মুহুর্তে ইবাদতে বিভোর থাকতে লাগলেন। তিনি কোন কোন সময় দৈনিক এক খতম কোরআন তিলাওয়াত করতেন।কখনও বিছানায় পিঠ বা পার্শ্বদেশ লাগিয়ে শয়ন করতেন না। অতি অল্প নিদ্রা যেতেন হাঁটুর উপর মাথা রেখে কিংবা ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে। গৃহের অন্দর কক্ষে মোটেও যেতেন না; কোর রকমে কেউ তাঁকে জোর করে ঘরে নিয়ে গেলেও নরবে ঘর থেকে বের হয়ে যেতেন এবং তাঁর মুরশীদ হযরত আকদাছ (কঃ)-এর খেদমতে হাজির হতেন। শরীরিক কষ্টের ফলে তাঁর জীবন নাশের আশঙ্কায় তাঁর মাতাপিতা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন এবং তাঁরা রেয়াজতের ভার কমিয়ে দেওয়ার জন্য হযরত আকদাছ (কঃ)-এর নিকট প্রার্থনা জানান। প্রত্যুত্তরে হযরত আকদাছ (কঃ) উর্দুতে যা বললেন তার মর্মার্থ এই, “তিনি ইউছুফ (আঃ) হতে চন আর তোমরা তাঁকে মৌলভী বানাতে চাও। খোদা তোমাদিগকে মান্না ও ছালওয়া নামক স্বর্গীয় খাদ্য খাওয়াতে চান। আর তোমরা পেঁয়াজ, রসুন খেতে চাও। তোমরা কি উৎকৃষ্ট বস্তুর বিনিময়ে নিকৃষ্ট বস্তু চাও?”

একবার ওয়াজ মাহফিল থেকে বাড়ী ফিরে এস হযরত বাবা ভান্ডারী (রঃ) হযরত আকদাছ (কঃ)-এর সাথে দেখা করতে যেয়ে দেখতে পান যে হযরত আকদাছ (কঃ) আপাদমস্তকে চাদর জড়িয়ে শয়ন করে আছেন। ইহা দেখে তিনি হযরত আকদাছ (কঃ)-এর গৃহে প্রবেশ না করে দরজার সামনে সারারাত দাঁড়িয়ে থাকেন। উল্লেখ্য যে, ঐদিন ওয়াজ মাহফিল থেকে ফিরে আসার সময় তাঁর মুখমন্ডল লোহিত বর্ণ ধারণ করেছিলেন। পরদিন তাঁর অবস্থার নতুন পরিবর্তন দেখা দেয়। তিনি হযরত আকদাছ (কঃ)-এর গৃহে প্রবেশ বন্ধ করে দেন। ঘরের বাহির থেকে হযরত আকদাছ (কঃ)-এর প্রতি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে শুরু করলে। এ সময় তাঁন দু’নয়ন থেকে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ত; কিন্তু মুখে কোন আওয়াজ ছিলনা। এভাবে কয়েক দিন অনাহারে থেকে তিনি উপবিষ্ট বা দন্ডায়মান অবস্থায় বরজখ ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। শীতকালে ঠান্ডা হওয়ায় তার শরীর বরফের ন্যায় শীতল হয়ে যেত। সাতদিন অন্তর এ সময় তিনি একদিন মাত্র আহার করতেন। এভাবে দু’বৎসর অতিবাহিত হবার পর তিনি আবার হযরতের গৃহে প্রবেশ করতে শুরু করলেন। কিন্তু তাঁর মধ্যে নতুন ভাবের উদয় হলো। মাঝে মাঝে তিনি অজ্ঞান অবস্থায় হযরত আকদাছ (কঃ)-এর চরণ যুগল জড়িয়ে ধরতেন। এতে হযরত আকদাছ (কঃ)-এর চরণ যুগল হযরত বাবা ভান্ডারী (কঃ) এর বাহুর বন্ধন থেকে মুক্ত করতে হোত। জোরপূর্বক হযরত বাবা ভান্ডারী (কঃ)-কে কোন ঘরে বন্ধ করে রাখতে হোত। তখন হযরত বাবা ভান্ডারী (কঃ) চিৎকার করে বলতেন, “ছেড়ে দাও, দেখতে দাও, আমার প্রাণ যায়”। এরূপ চিৎকার করতে করতে বেহুঁশ হয়ে যেতেন। জ্ঞান ফিরে আসার পর সুযোগ পাওয়া মাত্র ঘরের বাড়া কিংবা দরজা ভেঙ্গে দৌড়ে দিয়ে পুনরায় হযরত আকদাছ (কঃ)-এর চরণ যুগল জড়িয়ে ধরতেন। ছাড়া পেলেতো কথাই নেই। হযরত আকদাছ (কঃ)-এর চরণ যুগলে পতঙ্গের ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়াতেই তিনি অনাবিল শান্তি পেতেন। বস্তুতঃ পক্ষে তাঁর অন্তরে মনছুর হাল্লাজ (রঃ) সামছে ভাবরীজ (রঃ), শাহ-বুআলী কলন্দর (রঃ) ও হাফেজ সিরাজী (রঃ) এর মত প্রেমনেশা ছিল। এভাবে সুদীর্ঘ তিন বৎসর কাল অসাধারণ সাধনা ও ধৈর্য ও প্রতীক্ষার পর তাঁর প্রমাষ্পদ মুরশীদ হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী (কঃ)-এর আশীর্বাদ লাভ করে তিনি নব জীবন লাভ করেন এবং আধ্যাত্ম জগতের মহান সম্রাট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। আটাশ বৎসর বয়সে কঠোর আত্মিক ও দৈহিক সাধনার মাধ্যমে নফছ আস্মায়ার সকল কৃপ্রবৃত্তি দমন পূর্বক আত্মার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, শরীয়ত, তরিকত, হাকীকত ও মারেফাতের বিকাশ সাধনা করতঃ হযরত বাবা ভান্ডারী (কঃ)-আধ্যাত্মিক জগতের চরম সোপানে উন্নীত হন। ফলশ্রুতিতে তাঁর আত্মায় হযরত আকছাদ (কঃ) এর যাবতীয় আত্মিক শক্তি সঞ্চারিত হয়। এ সময় থেকে হযরত আকদাছ (কঃ) তাঁর মুরীদদেরকে তালিম দেওয়ার জন্য হযরত বাবা ভান্ডারী (কঃ)-এর সমীপে পাঠাতে লাগলেন এবং এভাবে তিনি পরোক্ষভাবে হযরত বাবা ভান্ডারী (কঃ) কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করলেন। হযরত বাবা ভান্ডারী (কঃ) জলে-স্থলে, পাহাড়-পর্বতে ভ্রমণের কাজে নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন দীর্ঘকাল যাবত। তিনি সংসারের যাবতীয় মোহমায়া, সুখ-শান্তি প্রভৃতির প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে হযরত আকদাছ (কঃ)-এর নির্দেশক্রমে গাউছিয়তের কার্য পরিচালনার জন্য প্রস্তুতি হিসেবে পূর্ব পার্বত্য চট্টগ্রাম, দেয়াঙ্গের পাহাড়, উত্তর পাহাড়, সীতকুন্ড পাহাড়, গভীর অরণ্য প্রভৃতি দিবসের অবসানে কিংবা রজনীর ঘোর অন্ধাকারে শ্বাপদ সঙ্কুল পরিবেশকে উপেক্ষা করে ভ্রমণ করে নিজেকে লোকালয় থেকে দূরে রাখেন জীবনের চল্লিশ বৎসর বয়সকালে উপনীত হওয়া অবধি। তাঁর এ সব ভ্রমণের রহস্য সাধরণের বোধগম্য নয়।

হযরত বাবা ভান্ডারী (কঃ)-এর দৈহিক বৈশিষ্ট্য

তাঁর দৈহিক সৌন্দর্য ছিল অপরূপ ও অতুলনীয়। নবজাত শিশু হযরত বাবা ভান্ডারী (কঃ) কে কোলে নিয়ে হযরত আকদাছ (কঃ) বলেছিলেন,

“ইয়ে হামারে বাগকা গোলে গোলাপ হ্যায়। হযরত ইউছুফ (আঃ) কো চেহারা ইছমে আয়া হায়। ইছকো আজিজ রাখো। মায়নে ইছকো নাম গোলামুর রহমান রাখা”।

অর্থাৎ “এ শিশু আমার বাগানের গোলাপ ফুল। হযরত ইউছুফ (আঃ)-এর রূপ লাবণ্য তাঁর মধ্যে বিদ্যমান। তাঁকে যত্ন করো। তাঁর নাম গোলামুর রহমান রাখলাম”।

হযরত বাবা ভান্ডারী (রঃ)-এর স্বভাব, প্রকৃতি ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য

হযরত বাবা ভান্ডারী (কঃ) ছোট বেলা থেকেই সংযত স্বভাবের ছিলেন। তিনি শিশু অবস্থায় কখনও বিছানা বা দোলনায় প্রস্রাব করেননি। প্রস্রাব পায়খানার সময় হলে তাঁর অবয়বে এমন কতগুলো লক্ষণ দেখা যেত যাতে তাঁর মা ছেলের প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার বিষয় বুঝে নিতে পারতেন। বিছানার বাহিরে নিলেই তিনি বাহ্য প্রস্রাব করতেন। তিনি অন্যান্য ছেলেদের মত কান্নকাটি করে কাউকে বিরক্ত করতেন না। একদা তাঁর আম্মাজান তাঁকে দোলনায় শুইয়ে রেখে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েন। হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গলে তিনি দেখেন যে দোলনা দুলছে এবং নবজাত শিশু চোখ বুজে ঘুমাচ্ছে। অথচ দোলাবার মত কোন লোক সেখানে উপস্থিত ছিলনা। এরূপ অস্বাভাবিক ব্যাপার দেখে তাঁর মাতা ইহা একটি আলৌকিক ঘটনা বলে অনুমান করেছিলেন। তিনি ছোট বেলায় মিতভাষী, ধর্ম পরায়ণ ও মিতব্যয়ী হিসেবে সকলের প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। তিনি বিনা প্রয়োজনে কারো সাথে বাক্যালাপ করতেন না। তিনি ছাত্রাবস্থায় কঠোর পাঠাভ্যাস করতেন, অল্প ঘুমাতেন এবং বাকী সময় উপাসনায় মগ্ন থাকতেন। রমজানের ঈদ ও কোরবানের ঈদের সময় ব্যতীত ২৪ ঘন্টার মধ্যে কেবল সন্ধ্যাকালে একবেলা তিনি আহার করতেন। তিনি ছিলেন “ছায়েমুদ্দাহার” অর্থাৎ সারা বছর রোজা পালনকারী। তাঁর কন্ঠ ছিল সুললিত ও সুমধুর। তাঁর সুমধুর আওয়াজ ও কোরআন তেলাওয়াত মানুষকে মুগ্ধ করত। বেলায়তী ক্ষমতা লাভের পর হযরত বাবা ভান্ডারী (রঃ) প্রায়শঃ ধ্যানে বিভোর থাকতেন। প্রায়শঃ তাঁকে আপাদমস্তক চাদর ঢাকা দিয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যেতো। মাঝে মধ্যে তিনি তাঁর হস্ত মোবারকের পানি ছিটিয়ে দিতেন। বলাবাহুল্য, তাঁর এ ছিটানো পানি ছিল সর্ব রোগের মহৌষধ। কত লোক যে তাঁর ছিটানো পানি দ্বারা উপকৃত হয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। তিনি তামাক খেতে পছন্দ করতেন। সৌখিন বিভিন্ন জাতীয় মসলা দ্বারা প্রস্তুত তামাক সৌখিন সুদীর্ঘ নলওয়ালা হুক্কায় সাজিয়ে রাখত ভক্তরা এবং তিনি উহাতে মাঝে মধ্যে টান দিতেন।। যার দিকে তিনি নজর করতেন সে খাঁটি সোনা হয়ে যেত। প্রকৃতপক্ষে তিনি হলেন মজজুবে ছালেক এব মহান ওলী-আল্লাহ।
ওলী হিসেব হযরত বাবা ভান্ডারী (কঃ)-এর মর্যাদার স্তর

হযরত আকদাছ (কঃ)-এর পর হযরত বাবা ভান্ডারী (কঃ) হলেন মাইজভান্ডার শরীফের দ্বিতীয় মহান ওলী। তাঁর সম্পর্কে হযরত আকদাছ (কঃ)-এর মহান বাণীল মধ্যেই তাঁর মর্যাদার প্রকৃষ্ট পরিচয় মেলে। আবদুল মজিন নামে এক বৃদ্ধ খাদেমের কথার উত্তরে হযরত আকদাছ (কঃ) বলেছিলেন,

“মিঞা, উয়হ শাহে জালাল হ্যায়, মুরকে ইয়মন কা রহনে ওয়ালা হ্যায়। আলমে আবহাওয়া মে ছায়ের করতা হ্যায়”।

অর্থাৎ “তিনি জালালিয়তের সম্রাট ইয়ামত (দূর) দেশের অধিবাসী, তিনি রূহ জগতে ভ্রমণ করেন”  হযরত আকদাছ (কঃ) একবার তাঁর (বাবা ভান্ডারী (কঃ) এর) মাতাকে বলেছিলেন, “আপ পীরানে পীর ছাহেবকা মা”। হযরত আকদাছ (কঃ)-এর মহান বাণীসমূহ থেকে ইহা স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে হযরত বাবা ভান্ডারী (কঃ) একজন মহান ত্রাণ কর্তৃত্ব সম্পন্ন ওলী ছিলেন।

অপূর্ব মাধুর্য মন্ডিত উদার মানবতাকামী হযরত বাবা ভান্ডারী (কঃ)

হযরত বাবা ভান্ডারী (কঃ) সাধারণত কোন কথা বলতেন না। কোন সময় কিছু কথা বললেও তা ছিল খুব সংক্ষিপ্ত, রূপক ও বহু অর্থবোধক। অবশ্য তাঁর আদেশ-নিষেধ, ইচ্ছা-অনিচ্ছা প্রবৃতি দর্শনার্থী হাজতী ও মকছুদীগণ ঠিকই বুঝতে পারত। তিনি যাকে যা জানাতে চাইতেন তা সে জানত। তাঁর চরণে কোন নিবেদন পৌছাতে মৌখিক কোন কথার প্রয়োজন হতনা। মনে মনে কংকল্প করলেই যথেষ্ট ছিল। বিভিন্ন ভাষাভাষী লোকের তাঁর দরবারে সমাগম ছিল। তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ জবাব পেত। অনুগ্রহ-প্রত্যঅশীরা তাঁর অনুগ্রহ লাভ করে ধন্য হত। ভক্ত-আশেকদেরকে তিনি মৌখিক কোন উপদেশ দেননি। ইঙ্গিত-ইশারা বা স্বপ্নযোগে ভক্ত-আশকগণ তাঁর আদেশ-নিষেধ বুঝতে পারত, বর্তমানেও পারে। তাঁকে স্বচক্ষে একবার দেখবার সৌভাগ্য যার হয়েছে সে জীবনে তাঁকে বিস্মৃত হতে পারেনি। হযরত বাবা ভান্ডারী (কঃ)-এর দরবারে হযরত আকদাছ (কঃ)-এর দরবারের ন্যায় জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের অবাধ গমন ছিল। তিনি ছেমা বা গান-বাজনা সহকারে জিকির পছন্দ করতেন। তাঁর চলনে বলতে চিশতিয় ত্বরিকার প্রভাব ছিল অধিক।

ওলী সৃষ্টিতে হযরত বাবা ভান্ডারী (রঃ)-এর অবদান

হযরত বাবা ভান্ডারী (কঃ)-এর কেরামত সমূহ

হযরত বাবা ভান্ডারী (কঃ)-এর কেরামতের কথা বলে শেষ করা যাবেনা। তাঁর কেরামত অসংখ্য। সুউচ্চ পাহাড়ের চুড়ায় সাদা পোষাক পরিহিত স্বর্গীয় লোকজনদের সাথে গভীর রাত্রিতে সাক্ষাৎকার, বিষবৎ মাকাল ফল সুমিষ্ট ফলে রূপান্তরিত হওয়া, তাঁকে দেখে হিংস্র রাম কুকুরের ঝাঁকের পলায়ন, তাঁকে হিংস্র বাঘের সালাম নিবেদন, ঝুর্মিয়াকে জীবন দান, আসগর শাহ নামীয় ফকিরকে প্রহার করে সাগরে প্রেরণ, রেল লাইনের উপর হযরত বাবা ভান্ডারী (কঃ) এর বসার কারণে আসাম মেইল ট্রেন ছাড়ার পর সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার পরিবর্তে পেছনের দিকে গমন, পাতার রস গরম করে ঢেলে তামার পয়সাকে সোনার পয়সায় পরিণতকরণ, বিশালকায় সাপ ফনা বিস্তার করে হযরত বাবা ভান্ডারী (কঃ) কে ছায়া প্রদান, রেল লাইনের উপর বসে চলন্ত ট্রেনকে থামিয়ে বহুদুরে অবস্থিত সম্মুখস্থ গাছের ব্যারিকেড থেকে ট্রেনকে উদ্ধার, এই সময়ে বিভিন্ন স্থানে দর্শন দান, মৃত ব্যক্তিকে জীবিতকরণ প্রভৃতি অজস্র ঘটনা তাঁর আশ্চর্য কেরামতের সাক্ষ্য বহন করে যা নিঃসন্দেহে হযরত বাবা ভান্ডারী (রঃ)-এর মত একজন মহান ওলীর পক্ষেই কেবল সম্ভবপর ছিল।
হযরত বাবা ভান্ডারী (কঃ)-এর তিরোধান

এ মহান ওলী সুদীর্ঘ একত্তর বৎসর ছয় মাস ইহধামে আধ্যাত্মিক লীলা সম্পাদন করে ১৩৪৩ বাংলার ২২শে চৈত্র [মোতাবেক ১৯৩৭ খৃষ্টাব্দের ৫ই এপ্রিল, ১৩৪৬ হিজরীর ২২শে মহররম] রোজ সোমবার ভোর ৭টা ৫৫ মিনিটের সময় সকল ভক্ত অনুরক্তকে শোক সাগরে ভাসিয়ে মহান প্রভুর সাথে মিলনার্থে পরপারে আত্মগোপন করেন। (ইন্না………….রাজিউন)

(সংগৃহীত)

Comments

comments